রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত রিকশা। এসব অবৈধ যান বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও উলটো বাড়ছে এর সংখ্যা। অলিগলি থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়কে এসব রিকশা দাপটের সঙ্গে চলায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষের মৃত্যু হয়, এর ২০ শতাংশই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায়। কদমতলীর জুরাইনে বুধবারও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচাপায় ৭ বছরের এক শিশু শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরেক শিশু।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব অবৈধ যান বন্ধ না হওয়ার পেছনে রয়েছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা, পুলিশ ও চাঁদাবাজরা জড়িত বলেও অভিযোগ উঠেছে।
একাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক জানিয়েছেন, তারা মাসোহারা দিয়ে টোকেন নিয়েই সড়কে চালান। প্রতিমাসে টোকেন খরচ ৭শ থেকে ১ হাজার টাকা নেওয়া হয়। বিনিময়ে ‘সেভেন স্টার’, ‘ম’, ‘শাপলা’, ‘কদমফুল’, ‘ধানের শীষ’, ‘নৌকা’সহ বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে টোকেন ধরিয়ে দেওয়া হয়। টোকেন থাকলে এসব রিকশা পুলিশ ধরে না। আর টোকেন না থাকলেই ধরে নিয়ে যায়, একেকটি রিকশা ছাড়াতে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হয়।
রিকশার কাঠামোতে মোটর যুক্ত করে ব্যাটারির সাহায্যে চলে এই তিন চাকার বাহন। তিন চাকা ইজিবাইকও চলে ব্যাটারিতে। দুর্বল কাঠামো আর ভারসাম্যহীনতার কারণে এসব বাহনকে ঝুঁকিপূর্ণ বলছে বুয়েটের গবেষণা।
পুলিশের ভাষ্যমতে, সারা দেশে এসব রিকশা আর ইজিবাইকের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। আর রাজধানীতেই রয়েছে ১২ লাখের মতো, যা বন্ধে গত বছর নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। সেই সঙ্গে জীবিকার বিষয়টিও ভাবতে হবে। চাইলে কাঠামোর মান উন্নয়ন করে এগুলো সড়কে চলাচলের উপযোগী করা সম্ভব।
রাজধানীর শ্যামপুর, জুরাইন, কদমতলী, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, দারুসসালাম, কাফরুল, পল্লবী, উত্তরা, উত্তরখান, দক্ষিণখান,খিলগাঁও, সবুজবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, তুরাগ, হাজারীবাগ, আদাবর থানা এলাকার অলিগলিতে অবাধে চলছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা। পুলিশের চোখের সামনেই এগুলো দেদার চলাচল করছে, সৃষ্টি হচ্ছে অহরহ যানজট। এছাড়া প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। তবুও নিষিদ্ধ এ যানবাহনগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, কদমতলী ও জুরাইন এলাকায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক রয়েছে। শামীম ও আলমগীরসহ অন্তত ৬ জন নিয়ন্ত্রণ করেন এই এলাকার টোকেন বাণিজ্য। তাদের মাসোহারা দিয়ে টোকেন নিয়ে এসব রিকশা চলাচল করে ওই এলাকায়।
সূত্র জানায়, একেকটি ব্যাটারিচালিত রিকশার জন্য টোকেন নিতে তাদের দিতে হয় ৭শ আর ইজিবাইকের জন্য ১ হাজার টাকা। তারা টোকেনগুলো বিভিন্ন এলাকার গ্যারেজে রেখে আসেন। আর গ্যারেজ থেকেই তারা টাকা সংগ্রহ করে নেন। শুধু এই এলাকাই নয়, প্রতিটি এলাকায় ইজিবাইক ও ব্যাটারির রিকশা থেকে এভাবেই রমরমা টোকেন চাঁদাবাজি চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণখান এলাকায় বিমানবন্দর রেললাইন থেকে দক্ষিণখান, তালতলা, কসাইবাড়ী থেকে দক্ষিণখান বাজার, কসাইবাড়ী থেকে কাঁচকুড়া, হাজি ক্যাম্প থেকে কাঁচকুড়া এবং আবদুল্লাহপুর থেকে উত্তরখান মাজার রোডসহ অন্যান্য পয়েন্টে চলাচল করছে কয়েক হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। প্রভাবশালী দলের স্থানীয় নেতা, পুলিশ ও মাস্তানদের চাঁদা দিয়েই এ রুটে এসব যান চালানো হয় বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চালক যুগান্তরকে জানিয়েছেন।
উত্তরা ৪ ও ৮নং সেক্টরের আবহাওয়া কোয়ার্টারের সামনে পাঁচ শতাধিক ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণ করেন ওখানকার কতিপয় প্রভাবশালী। ৪ নম্বর সেক্টরে শাহজালাল অ্যাভিনিউয়ে তিন শতাধিক ইজিবাইক চলে এবং এগুলো খুবই বেপরোয়া। এদিকে তালতলা ও ডুমনি, বিমানবন্দর ট্রাফিক পুলিশ বক্স থেকে সিভিল এভিয়েশন কোয়ার্টার, খিলক্ষেত বাজার থেকে লেকসিটি, কসাইবাড়ী থেকে দক্ষিণখান বাজার ও ইউনিয়ন, জয়নাল মার্কেট থেকে দক্ষিণখান বাজার, আজমপুর থেকে উত্তরখান থানা এবং ময়নারটেক ও আবদুল্লাহপুর থেকে উত্তরখান।
এসব রুটে অন্তত সাড়ে তিন হাজার ইজিবাইক ও অটোরিকশা চলে। এসব এলাকার ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা অভিযোগ করে বলেছেন, তারা মাসোহারা দিয়েই রিকশা চালান। তবে যাদের মাসোহারা দেন, তাদের নাম বললে রাস্তায় রিকশা চালানো সম্ভব হবে না।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার ফারুক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সারা দেশে ৬০ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আছে। রাজধানীতে আছে প্রায় ১২ লাখ। এসব রিকশা অলিগলিতে চলে। তবে মূল সড়কে উঠলেই ডাম্পিং করা হয়। তাছাড়া ডিএমপি একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে অবৈধ গ্যারেজ বন্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। তিনি বলেন, কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পেলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহন পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।